০৭:৪৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪
জীবনানন্দ

নিবিড় নিবন্ধে জীবনানন্দ…

আধুনিক কবিতার উদ্ভব-বিজয়-প্রতিষ্ঠা বিশশতকী বাঙলা সাহিত্যের সবচেয়ে বড় ঘটনা। এর চেয়ে উজ্জ্বল ও মূল্যবান আর কিছু ঘটে নি এ-শতকে। এমন রঙিন ও রঙহীন, দ্রোহী ও আনত, সুখকর ও সুখহর, সমকালমগ্ন ও মহাকাললুব্ধ, ব্যক্তিগত ও নৈর্ব্যক্তিক, বিশ্বমুখি ও স্বদেশলগ্ন, এবং জ্ঞানী ও মেধাবী আর কিছু জন্মে নি বিশশতকী বাঙলা সাহিত্যে। আধুনিক কবিতাই সে-বিশালব্যাপক পথ, যে-পথে বিংশশতাব্দী প্রবেশ করে বাঙলায়। বাঙলা সাহিত্যে বিংশশতাব্দী ও আধুনিক কবিতা তাই সমার্থক প্রায়। পাঁচজন আদিম দেবতা এ-আধুনিকতার বাহক। ত্রিশের দশকে তাঁরা এলেন; এবং বদলে দিলেন বাঙলা কবিতাকে– বক্তব্যে, ব্যঞ্জনায়, চিন্তায়, শব্দে, কলাপ্রকৌশলে। শুধু কি তাই, অভিনব সে-দেবতাদের শ্রম-সাধনা বদলাল বাঙালির জীবন ও শিল্প-চেতনাও। জীবনকে তাঁরা পরালেন জটিল নতুন পোশাক; শিল্পকে দিলেন জটিলতর নতুনতর প্রাণ ও পোশাক– কবিতাসৃষ্টির ভূ-ভাগ থেকে অমেধাবীদের বিদায়ের দিন ঘনিয়ে এল। প্রতিভাবান সে-পাঁচজনই আধুনিক কবিতার পঞ্চশূর। বাঙলাভাষায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও রবীন্দ্রনাথের পর যথার্থ নতুন কবিতা সৃষ্টি হয়েছে তাঁদের হাতেই।

ছবি : সংগৃহিত

জীবনানন্দ দাশ সেই পাণ্ডবদের অন্যতম, যিনি আধুনিক কবিতার মাধ্যমে তাঁর চিন্তারাশিকে পরিণত করেছেন সৌগন্ধে-সৌন্দর্যে, এবং বাঙলাকে করে তুলেছেন স্বপ্নভাষা। এ-বিষয়ে বুদ্ধদেব বসু, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, দীপ্তি ত্রিপাঠী, অম্বুজ বসু, মাহবুব সাদিক প্রমুখেরা গভীর ও ব্যাপক আলোচনা করেছেন। জ্ঞানগর্ভ সে-সব আলোচনার বাইরেও বহু সমীক্ষা ও লেখালিখি রয়েছে; এবং আজও অব্যাহত সে-চর্চা, যার ধারাবাহিকতায়, মেধা ও মননের সমন্বিত পরিশ্রমে, নিজেকে যুক্ত করেছেন সৈকত রহমান। তিনি নিজেও কবি– কবিতায় নিরন্তর চর্চা করেন শুদ্ধতার– মননশীলতার ক্ষেত্রেও বেছে নিয়েছেন শুদ্ধতমকেই। সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন, জীবনানন্দে তাঁর আগেই বসবাস ছিল– অনেক সাঁতার কেটেছেন তাঁর কাব্যসমুদ্রে; নব্বইয়ের গোড়ায় এসে ডুব দেন অতলে– অগাধ-সমুদ্র মন্থন ক’রে তুলে আনেন অজস্ত্র মনিমুক্তো, যার গ্রন্থিত রূপ ‘জীবনানন্দ দাশের কাব্য : ১২ নিবন্ধ’।

জীবনানন্দ দাশের কাব্যের ওপর সৈকত রহমানের বিভিন্ন সময়ে লেখা বারোটি নিবন্ধ স্থান পেয়েছে এ-গ্রন্থে। প্রতিটি নিবন্ধই উল্লেখযোগ্য ও তাৎপর্যবাহী। প্রথমেই আছে ‘রূপসী বাংলা : ঐতিহ্য, প্রেম, স্বপ্ন ও সার্থকতা’। এ-নিবন্ধে ইতিহাস-ঐতিহ্য চেতনার সাথে আবহমান বাঙলা ও বাঙালিকে ঘিরে জীবনানন্দের যে প্রেম, স্বপ্ন ও স্বার্থকতা, সে-সবের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ আর অনুপম বয়ান দিয়েছেন সৈকত রহমান; রূপসী বাংলা-র প্রেক্ষাপট প্রসঙ্গে যেমন বলেছেন: বাঙালি তার মূল শেকড়ের গান শুনতে চাচ্ছে। জীবনানন্দ সঠিক সময়ে সঠিক উপলব্ধিজাত শিল্পবীজ বপন করলেন। রূপসী বাংলা-র মাধ্যমে বাঙালি অনুভব করল অনাড়ম্বর কিন্তু ঐশ্বর্যশালী ভূমির অধিবাসী সে, মাটির কাছে মাটির মানুষের স্বপ্নের সাধ এই পৃথিবী নামক আশ্চর্য গ্রহটির কাছে সব পাওয়ার দেশ যেন তাঁর। বাঙালি এই পরিপূর্ণ জাতি এবং তার অতীতের সুখ, সংগ্রাম, স্বপ্ন, ব্যর্থতা, বেদনা, কল্পনাশক্তির ঐশ্বর্য কখনও বিলীন হবার নয়।

এরপর ‘রূপসী বাংলার ঘাস : চিরদীপ্তিমান স্বদেশের নাম’। এ-নিবন্ধে ঘাস কীভাবে সবুজ আদিমতা ও চিরন্তনের প্রতীক হয়ে উঠেছে এবং সবকিছুর ভেতর দিয়ে আবহমান বাঙলার প্রতিনিধিত্ব করছে, তার উদ্ধৃতিসহ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আবহমানকাল ধরে বাংলার সংস্কার, ইতিহাসের ওলটপালট ও নানা বাঁক পেরিয়ে বেদনা ও ঐশ্বর্যের মাঝে তার প্রাণবান সবুজ ঘাস ও ধানের প্রাচুর্য ও প্রফুল্লতা অব্যাহত থাকে। এখানে নদনদী, সমুদ্র, মেঘের পানি যেমন অবারিত তেমনি অবিরাম ফলে ওঠে ঘাস আর ধান। এই ছবি আঁকতে কবির লেখনী অক্লান্ত ও রসতৃপ্ত সর্বদা। মৃত্যুর অমোঘ হাজিরাকে তিনি ঘাসের বর্ণময়তা ও প্রশান্তিতে লাভ করতে চান : ‘একদিন জলসিঁড়ি নদীটির পারে এই বাংলার মাঠে/ বিশীর্ণ বটের নিচে শুয়ে রব, পশমের মতো লাল ফল/ ঝরিবে বিজন ঘাসে, বাঁকা চাঁদ জেগে রবে…/ ভিজে পেঁচা শান্ত স্নিগ্ধ চোখ মেলে কদমের বনে/ শোনাবে লক্ষ্মীর গল্প, ভাসানের গান নদী শোনাবে নির্জনে;/ চারিদিকে বাংলার ধানীশাড়ি শাদাশাঁখা– বাংলার ঘাস।’

‘রূপসী বাংলা’র পর জীবনানন্দের সবচেয়ে লোকপ্রিয় কাব্য বনলতা সেন। মানবজীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ সৌন্দর্যচেতনা, আনন্দ, গতিময়তা, প্রেম, প্রজ্ঞা– এসবের শিল্পিত প্রকাশ ঘটেছে এ-কাব্যে। কিন্তু কীভাবে?  সৈকত রহমান তাঁর ‘বনলতা সেন : তৃপ্তি ও উত্তরণের নতুন পর্ব’-এ পরম যত্নে ফুলের পাপাড়ির মতো খুলে খুলে দেখিয়েছেন। তাঁর পর্যবেক্ষণে ‘বনলতা সেন’ গোটা কাব্যের ভেতরে বেশকিছু কবিতার মর্মে এক আদর্শিক সুরের ঐক্য পাওয়া যায়। এ-আদর্শিক সুরটি বইয়ের প্রথম কবিতা ‘বনলতা সেন’-এ যেভাবে মূর্ত হয়ে আছে– তাকে আরও বিচিত্রমুখী ভাবোদ্যোতক স্পষ্টতা দেবার জন্যে সুদর্শনা, শ্যামলী, সুরঞ্জনা, সবিতা, সুচেতনা ও মিতভাষণ কবিতায় নিয়ে গেছেন। এ-আদর্শিক সুরের ইশারা ‘আমাকে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন’ চরণের মধ্যে ‘শান্তি’ শব্দটিতে খোঁজ করতে পারি। এই শান্তির অপর নাম জীবনাকাঙ্খা রাখতে পারি, যা জীবনানন্দ দাশের বহু কবিতায় সত্যতার নারীসত্তায় বিরাজমান।

জীবনানন্দ দাশের ‘মহাপৃথিবী’ কাব্যের ঢের আলোচনায় হয়ে উঠেছে এ-বইয়ের ‘মহাপৃথিবী : হৃদয়ে বিরস বেদনার গান’ শীর্ষক নিবন্ধ। ‘মহাপৃথিবী’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে (১৯৮৮ খ্রি.) প্রকাশিত কাব্য। বাঙলায় তখন তেতাল্লিশের মন্বন্তর– বিশ্বব্যাপী মানবসমাজের জন্যে এক অন্তহীন দুর্ভাগ্য নেমে এসেছে। সে-তমশাচ্ছন্ন প্রেক্ষাপটে মহাযুদ্ধের অভিঘাতে সৃষ্ট চেতনাবোধ, অগ্নিদাহ, নির্মমতাদীর্ণ বেদনাবোধ কাজ করেছে এ-কাব্যের হয়ে-ওঠায়। এ-বোধ যে সম্পূর্ণ সমাজাঙ্গিক– যে-সমাজচেতনা কবি দুর্যোগময় জীবনযাপন ক’রে পৃথিবীর পথে হেঁটে গভীর ধ্যানে উপলব্ধি করেছিলেন– সে-কথাই এ-নিবন্ধের সারকথা।

জীবনানন্দ দাশ যখন সাতটি তারার তিমির রচনা করেন তখন প্রাজ্ঞমনের অধিকারী, জীবন সমাজ বিশ্বইতিহাস ধর্ম দর্শন রাজনীতি আর্থনীতি বিজ্ঞান প্রভৃতির কল্যাণ-অকল্যাণ অনেকটাই তাঁর দিব্যদৃষ্টিতে ধরা পড়েছে। এ-সময় তাঁর শব্দচয়ন ও উপমা নির্মাণের ভেতরে পাওয়া যায় এক অটুট তারুণ্য, ভাষায়ও নতুন ঔজ্জ্বল্য ও নবীনতম দিকনির্দেশনা– এরকম বহুদিক থেকেই এটি সফল কাব্য ‘সাতটি তারার তিমির : তবু হৃদয়ে দীপ্তি আছে’ সে-সাফল্যেরই সাক্ষ্য দেয়।

জীবনানন্দ দাশের শেষকাব্য ‘বেলা অবেলা কালবেলা’-র ওপর আলোকপাত করে নির্মিত হয়েছে এ-বইয়ের ‘বেলা অবেলা কালবেলা : আঁধারকে আলোকিত করার প্রমিতি’। এ-নিবন্ধে দেখা যায় সমকালীন যুদ্ধাবস্থা ও হতাশার মধ্যেও কবি বিশ্বমানবিকতা ও বিজ্ঞানমনস্ক উদার বিবেকী সুর গাঁথতে চেয়েছেন। ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ কাব্যের অধিকাংশ কবিতায় সমাজের এক অটুট বন্ধ্যাত্বের প্রতিকারহীনতা চেতনাশীল হয়ে উঠেছে; এর মর্মপ্রকোষ্ঠের ভিতে মাথা কুটে মরছে প্রৌঢ় উন্মাদগ্রস্ততা, অভিশপ্ত হয়ে উঠেছে প্রাণের সব আকুলতা। উল্লিখিত নিবন্ধে সে-আকুলতাই মর্মভেদী রূপ নিয়েছে।

ছবি : সংগৃহিত

‘বেলা অবেলা কালবেলা’-য় নারীর কী অবস্থান তারও সুলুক সন্ধান চালিয়েছেন সৈকত রহমান। অনুসন্ধানী সে-প্রতিবেদনের আন্তরিক উপস্থাপন হয়ে উঠেছে একটি পৃথক নিবন্ধ, যার নাম ‘তুমি যে শরীর নিয়ে রয়ে গেছ’। মনোগ্রাহী নিবন্ধটি ঠাঁই পেয়েছে বইয়ের সপ্তমে;

অষ্টমে রয়েছে ‘‘শিকার’ : শিল্পের মোড়কে প্রতিবাদ”। একটি কবিতা নিয়ে একটি নিবন্ধ। কবিতার নাম ‘শিকার’। বনলতা সেন কাব্যের একটি প্রতিবাদী কবিতা এটি। পাঠক-সংযোগের ক্ষেত্রে কবিতাটি যেমন দুর্বোধ্য নয়, তেমনই মনোগ্রাহী বা চমকে দেবার মতো কিছু উপমা-উৎপ্রেক্ষার উদাহরণও আছে, যা বাঙালি কবিতাপ্রিয় পাঠককে চিরকাল আনন্দই দেবে, প্রেম বিলাবে, এবং প্রেরণা যোগাবে প্রতিবাদী হতে; কেননা, প্রকৃতিচিত্রে মোড়ানো থাকলেও শিল্পের মোড়কে এটি প্রতিবাদেরই কবিতা– এমন উৎসাহব্যঞ্জক তথ্যপ্রমাণ উঠে এসেছে এ-নিবন্ধে।

‘হেমন্তে ঘাসে নীল ফুল ফোটে’ ‘রূপসী বাংলা’ নিয়ে সৈকত রহমানের আরেকটি নিবন্ধ। এরও যাবতীয় উপকরণ এসেছে ‘রূপসী বাংলা’-র নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও বিস্তৃত গবেষণা থেকে। বাঙলার সবকিছু নিয়ে তাকে আমৃত্যু ভালোবেসে কীভাবে সুখী হয়েছিলেন জীবনানন্দ তার আদ্যোপান্ত জানানো হয়েছে এ-নিবন্ধে : ‘রূপসী বাংলা’র প্রেমানুভূতি যেসব সৌন্দর্য ভাব ভাবাপন্নতা আমাদের ছোঁয়, ছেনে যায় এবং দ্রবীভূত করে, তার মধ্যে হেমন্ত ঋতুর পাতাদের কষ আঠা দারুণ করে মিশেল আছে। হেমন্তের শান্ত মাধুর্য কবিপ্রাণে কাব্যপ্রেরণার উৎস।… কলকাতার নাগরিকজীবনে বরিশালের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও তার ভেতরে নিজের সর্গসুখ আস্বাদনের সময়টুকুর কথা কবি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে স্মরণ করেছেন বরাবর। এ-নিবিড় নিবন্ধে সে দীর্ঘশ্বাসও টের পাওয়া যায়।

জীবনানন্দ দাশের কাব্যভূবনে সমুদ্র যে-স্বতন্ত্র ভূগোল ও চেতনার বিস্তৃত নিগূঢ়তা নির্মাণ করেছে সেদিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন সৈকত রহমান। অনাদিকাল থেকে সমুদ্রের সাথে মানুষের যে-সম্পর্ক ‘ঢেউয়ের গানের শব্দ’ শীর্ষক নিবন্ধে তার স্বরূপ উন্মোচনের প্রয়াস পেয়েছেন। এর সমর্থনে কবির কাব্য থেকেই আহরিত হয়েছে প্রয়োজনীয় সব উপাদান। এ-বিষয়ে আরও বিস্তৃত গবেষণা ও আলোচনা-অনুসন্ধানেরও সুযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

‘ধূসর পাণ্ডুলিপির অন্তর্গত জগৎ’– শব্দগুচ্ছ ইঙ্গিত দেয় জীবনানন্দের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ কাব্যের অন্তর্গত জগতের কথাই বলা হয়েছে এ-নিবন্ধে। তাহলে কী আছে সে-জগতে? কবি একই সাথে মৃত্যু ও পরাজয়, শুভ ও সুন্দরের নান্দিকার– এ-বৈপরীত্যময় বোধগুলোকে মানবমনে একই অবস্থায় ঠাঁই দেয়ার যৌক্তিক শিল্পানুশীলনেই হয়ে উঠেছে ধূসর পাণ্ডুলিপি। মানুষের সব সৃষ্টি, সভ্যতা ও জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ ও প্রেমবোধ নিয়ে এ-কাব্যের যে-ধূসর রং ও রূপ, এবং তার আড়ালে লুকানো শক্তিমান ও মহত্তর অনুভবের কবি, তারও স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে।

ষড়ঋতুর অন্যতম হেমন্ত-কে কীভাবে দেখেছেন নিবন্ধকার, এবং জীবনানন্দেই বা তাকে কীভাবে পেয়েছেন, তার হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা দিয়েছেন ‘তবুও হেমন্ত’-এ। পরিশেষ এ-নিবন্ধে তিনি হেমন্তের প্রতি নিজের ব্যক্তিগত দুর্বলতা ও অনুভূতির সাথে জীবনানন্দের কবিতায় ব্যক্ত উপলব্ধির কী আশ্চর্য মিল তা জানিয়েছেন। তাঁর ভাষায়: ‘হেমন্ত হলো সেই বিষাদ মায়ার ঋতু, যা আমাকে দেয় অন্তর্গত ভাবনা সংগ্রহের অনুপ্রেরণা; নমিত করে, প্রণত করে, করেছিল আমাকে শৈশবে বারবার…’।

কাব্যিক হলেও সমগ্র উপস্থাপনে মেধা ও মননের সমন্বয় ঘটেছে ‘জীবনানন্দ দাশের কাব্য : ১২ নিবন্ধ’-এ; প্রয়োজনীয় তত্ত্ব ও তথ্যেরও কমতি পড়েনি। তবু কথা থেকে যায়, বুদ্ধদেব বসু যেমনটি বলেছিলেন: ‘জীবনানন্দ হচ্ছে নদীর স্রোতের মতো, কোথাও আঙুল দিয়ে বলা যাবে না যে এই হলেন জীবনানন্দ। জীবনানন্দ অতুলনীয় কারণ কোনও একটা একক রচনা দিয়ে তাঁকে চিহ্ণিত করা যাবে না, যেমন ফাউস্ট দিয়ে করা যাবে না গ্যাটে-কে, রবীন্দ্রনাথকে চিহ্ণিত করতে হবে তাঁর ব্যাপ্তি, বৈচিত্র্য ও পরিবেশন দিয়ে।’ এ-বাস্তবতায়ও সৈকত রহমানের ‘জীবনানন্দ দাশের কাব্য : ১২ নিবন্ধ’-এ জীবনানন্দের কবিতার ভিন্ন ও স্বতন্ত্র পাঠ নেওয়া যায়। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় উপস্থাপিত এ-পাঠ শুধু মুগ্ধ, বিস্মিত ও প্রাণিত করে না, বোধের লবণে দ্রবীভূত করে।

শিল্পী সুখেন দাসের আঁকা মনোরম প্রচ্ছদের এ-মলাটবন্দী আয়োজন বাঙলার ইতিহাস-ঐতিহ্য ও নিসর্গের সাথে জীবন ও প্রকৃতিকে, আদিগন্ত নতুন আলোয়, পরম মমতায়, ছুঁয়ে-ছেনে দেখার ডাক দেয়। গ্রন্থের ললাটে কাটা সংখ্যার তিলকটিও গ্রন্থিত নিবন্ধগুলোর বাইরে, জীবনানন্দ দাশের কাব্যের ওপর, গ্রন্থকারের আরও নিবন্ধের ইঙ্গিত দেয়; এবং সে-অগ্রন্থিত নিবন্ধেরও একটি গ্রন্থিত রূপ দেখতে আগ্রহ যোগায়। সবমিলিয়ে এ-এক অনন্য-সাধারণ পাঠ। সবুজ ঘাসের মতো নিবিড় ও সমৃদ্ধ এ-পাঠ পাঠককে জীবনানন্দ চর্চায় আরও উৎসাহিত করবে।

Tag :
About Author Information

জীবনানন্দ

নিবিড় নিবন্ধে জীবনানন্দ…

আপডেট টাইম : ১০:০৬:১০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৫ এপ্রিল ২০২২

আধুনিক কবিতার উদ্ভব-বিজয়-প্রতিষ্ঠা বিশশতকী বাঙলা সাহিত্যের সবচেয়ে বড় ঘটনা। এর চেয়ে উজ্জ্বল ও মূল্যবান আর কিছু ঘটে নি এ-শতকে। এমন রঙিন ও রঙহীন, দ্রোহী ও আনত, সুখকর ও সুখহর, সমকালমগ্ন ও মহাকাললুব্ধ, ব্যক্তিগত ও নৈর্ব্যক্তিক, বিশ্বমুখি ও স্বদেশলগ্ন, এবং জ্ঞানী ও মেধাবী আর কিছু জন্মে নি বিশশতকী বাঙলা সাহিত্যে। আধুনিক কবিতাই সে-বিশালব্যাপক পথ, যে-পথে বিংশশতাব্দী প্রবেশ করে বাঙলায়। বাঙলা সাহিত্যে বিংশশতাব্দী ও আধুনিক কবিতা তাই সমার্থক প্রায়। পাঁচজন আদিম দেবতা এ-আধুনিকতার বাহক। ত্রিশের দশকে তাঁরা এলেন; এবং বদলে দিলেন বাঙলা কবিতাকে– বক্তব্যে, ব্যঞ্জনায়, চিন্তায়, শব্দে, কলাপ্রকৌশলে। শুধু কি তাই, অভিনব সে-দেবতাদের শ্রম-সাধনা বদলাল বাঙালির জীবন ও শিল্প-চেতনাও। জীবনকে তাঁরা পরালেন জটিল নতুন পোশাক; শিল্পকে দিলেন জটিলতর নতুনতর প্রাণ ও পোশাক– কবিতাসৃষ্টির ভূ-ভাগ থেকে অমেধাবীদের বিদায়ের দিন ঘনিয়ে এল। প্রতিভাবান সে-পাঁচজনই আধুনিক কবিতার পঞ্চশূর। বাঙলাভাষায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও রবীন্দ্রনাথের পর যথার্থ নতুন কবিতা সৃষ্টি হয়েছে তাঁদের হাতেই।

ছবি : সংগৃহিত

জীবনানন্দ দাশ সেই পাণ্ডবদের অন্যতম, যিনি আধুনিক কবিতার মাধ্যমে তাঁর চিন্তারাশিকে পরিণত করেছেন সৌগন্ধে-সৌন্দর্যে, এবং বাঙলাকে করে তুলেছেন স্বপ্নভাষা। এ-বিষয়ে বুদ্ধদেব বসু, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, দীপ্তি ত্রিপাঠী, অম্বুজ বসু, মাহবুব সাদিক প্রমুখেরা গভীর ও ব্যাপক আলোচনা করেছেন। জ্ঞানগর্ভ সে-সব আলোচনার বাইরেও বহু সমীক্ষা ও লেখালিখি রয়েছে; এবং আজও অব্যাহত সে-চর্চা, যার ধারাবাহিকতায়, মেধা ও মননের সমন্বিত পরিশ্রমে, নিজেকে যুক্ত করেছেন সৈকত রহমান। তিনি নিজেও কবি– কবিতায় নিরন্তর চর্চা করেন শুদ্ধতার– মননশীলতার ক্ষেত্রেও বেছে নিয়েছেন শুদ্ধতমকেই। সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন, জীবনানন্দে তাঁর আগেই বসবাস ছিল– অনেক সাঁতার কেটেছেন তাঁর কাব্যসমুদ্রে; নব্বইয়ের গোড়ায় এসে ডুব দেন অতলে– অগাধ-সমুদ্র মন্থন ক’রে তুলে আনেন অজস্ত্র মনিমুক্তো, যার গ্রন্থিত রূপ ‘জীবনানন্দ দাশের কাব্য : ১২ নিবন্ধ’।

জীবনানন্দ দাশের কাব্যের ওপর সৈকত রহমানের বিভিন্ন সময়ে লেখা বারোটি নিবন্ধ স্থান পেয়েছে এ-গ্রন্থে। প্রতিটি নিবন্ধই উল্লেখযোগ্য ও তাৎপর্যবাহী। প্রথমেই আছে ‘রূপসী বাংলা : ঐতিহ্য, প্রেম, স্বপ্ন ও সার্থকতা’। এ-নিবন্ধে ইতিহাস-ঐতিহ্য চেতনার সাথে আবহমান বাঙলা ও বাঙালিকে ঘিরে জীবনানন্দের যে প্রেম, স্বপ্ন ও স্বার্থকতা, সে-সবের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ আর অনুপম বয়ান দিয়েছেন সৈকত রহমান; রূপসী বাংলা-র প্রেক্ষাপট প্রসঙ্গে যেমন বলেছেন: বাঙালি তার মূল শেকড়ের গান শুনতে চাচ্ছে। জীবনানন্দ সঠিক সময়ে সঠিক উপলব্ধিজাত শিল্পবীজ বপন করলেন। রূপসী বাংলা-র মাধ্যমে বাঙালি অনুভব করল অনাড়ম্বর কিন্তু ঐশ্বর্যশালী ভূমির অধিবাসী সে, মাটির কাছে মাটির মানুষের স্বপ্নের সাধ এই পৃথিবী নামক আশ্চর্য গ্রহটির কাছে সব পাওয়ার দেশ যেন তাঁর। বাঙালি এই পরিপূর্ণ জাতি এবং তার অতীতের সুখ, সংগ্রাম, স্বপ্ন, ব্যর্থতা, বেদনা, কল্পনাশক্তির ঐশ্বর্য কখনও বিলীন হবার নয়।

এরপর ‘রূপসী বাংলার ঘাস : চিরদীপ্তিমান স্বদেশের নাম’। এ-নিবন্ধে ঘাস কীভাবে সবুজ আদিমতা ও চিরন্তনের প্রতীক হয়ে উঠেছে এবং সবকিছুর ভেতর দিয়ে আবহমান বাঙলার প্রতিনিধিত্ব করছে, তার উদ্ধৃতিসহ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আবহমানকাল ধরে বাংলার সংস্কার, ইতিহাসের ওলটপালট ও নানা বাঁক পেরিয়ে বেদনা ও ঐশ্বর্যের মাঝে তার প্রাণবান সবুজ ঘাস ও ধানের প্রাচুর্য ও প্রফুল্লতা অব্যাহত থাকে। এখানে নদনদী, সমুদ্র, মেঘের পানি যেমন অবারিত তেমনি অবিরাম ফলে ওঠে ঘাস আর ধান। এই ছবি আঁকতে কবির লেখনী অক্লান্ত ও রসতৃপ্ত সর্বদা। মৃত্যুর অমোঘ হাজিরাকে তিনি ঘাসের বর্ণময়তা ও প্রশান্তিতে লাভ করতে চান : ‘একদিন জলসিঁড়ি নদীটির পারে এই বাংলার মাঠে/ বিশীর্ণ বটের নিচে শুয়ে রব, পশমের মতো লাল ফল/ ঝরিবে বিজন ঘাসে, বাঁকা চাঁদ জেগে রবে…/ ভিজে পেঁচা শান্ত স্নিগ্ধ চোখ মেলে কদমের বনে/ শোনাবে লক্ষ্মীর গল্প, ভাসানের গান নদী শোনাবে নির্জনে;/ চারিদিকে বাংলার ধানীশাড়ি শাদাশাঁখা– বাংলার ঘাস।’

‘রূপসী বাংলা’র পর জীবনানন্দের সবচেয়ে লোকপ্রিয় কাব্য বনলতা সেন। মানবজীবনের অন্যতম অনুষঙ্গ সৌন্দর্যচেতনা, আনন্দ, গতিময়তা, প্রেম, প্রজ্ঞা– এসবের শিল্পিত প্রকাশ ঘটেছে এ-কাব্যে। কিন্তু কীভাবে?  সৈকত রহমান তাঁর ‘বনলতা সেন : তৃপ্তি ও উত্তরণের নতুন পর্ব’-এ পরম যত্নে ফুলের পাপাড়ির মতো খুলে খুলে দেখিয়েছেন। তাঁর পর্যবেক্ষণে ‘বনলতা সেন’ গোটা কাব্যের ভেতরে বেশকিছু কবিতার মর্মে এক আদর্শিক সুরের ঐক্য পাওয়া যায়। এ-আদর্শিক সুরটি বইয়ের প্রথম কবিতা ‘বনলতা সেন’-এ যেভাবে মূর্ত হয়ে আছে– তাকে আরও বিচিত্রমুখী ভাবোদ্যোতক স্পষ্টতা দেবার জন্যে সুদর্শনা, শ্যামলী, সুরঞ্জনা, সবিতা, সুচেতনা ও মিতভাষণ কবিতায় নিয়ে গেছেন। এ-আদর্শিক সুরের ইশারা ‘আমাকে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন’ চরণের মধ্যে ‘শান্তি’ শব্দটিতে খোঁজ করতে পারি। এই শান্তির অপর নাম জীবনাকাঙ্খা রাখতে পারি, যা জীবনানন্দ দাশের বহু কবিতায় সত্যতার নারীসত্তায় বিরাজমান।

জীবনানন্দ দাশের ‘মহাপৃথিবী’ কাব্যের ঢের আলোচনায় হয়ে উঠেছে এ-বইয়ের ‘মহাপৃথিবী : হৃদয়ে বিরস বেদনার গান’ শীর্ষক নিবন্ধ। ‘মহাপৃথিবী’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে (১৯৮৮ খ্রি.) প্রকাশিত কাব্য। বাঙলায় তখন তেতাল্লিশের মন্বন্তর– বিশ্বব্যাপী মানবসমাজের জন্যে এক অন্তহীন দুর্ভাগ্য নেমে এসেছে। সে-তমশাচ্ছন্ন প্রেক্ষাপটে মহাযুদ্ধের অভিঘাতে সৃষ্ট চেতনাবোধ, অগ্নিদাহ, নির্মমতাদীর্ণ বেদনাবোধ কাজ করেছে এ-কাব্যের হয়ে-ওঠায়। এ-বোধ যে সম্পূর্ণ সমাজাঙ্গিক– যে-সমাজচেতনা কবি দুর্যোগময় জীবনযাপন ক’রে পৃথিবীর পথে হেঁটে গভীর ধ্যানে উপলব্ধি করেছিলেন– সে-কথাই এ-নিবন্ধের সারকথা।

জীবনানন্দ দাশ যখন সাতটি তারার তিমির রচনা করেন তখন প্রাজ্ঞমনের অধিকারী, জীবন সমাজ বিশ্বইতিহাস ধর্ম দর্শন রাজনীতি আর্থনীতি বিজ্ঞান প্রভৃতির কল্যাণ-অকল্যাণ অনেকটাই তাঁর দিব্যদৃষ্টিতে ধরা পড়েছে। এ-সময় তাঁর শব্দচয়ন ও উপমা নির্মাণের ভেতরে পাওয়া যায় এক অটুট তারুণ্য, ভাষায়ও নতুন ঔজ্জ্বল্য ও নবীনতম দিকনির্দেশনা– এরকম বহুদিক থেকেই এটি সফল কাব্য ‘সাতটি তারার তিমির : তবু হৃদয়ে দীপ্তি আছে’ সে-সাফল্যেরই সাক্ষ্য দেয়।

জীবনানন্দ দাশের শেষকাব্য ‘বেলা অবেলা কালবেলা’-র ওপর আলোকপাত করে নির্মিত হয়েছে এ-বইয়ের ‘বেলা অবেলা কালবেলা : আঁধারকে আলোকিত করার প্রমিতি’। এ-নিবন্ধে দেখা যায় সমকালীন যুদ্ধাবস্থা ও হতাশার মধ্যেও কবি বিশ্বমানবিকতা ও বিজ্ঞানমনস্ক উদার বিবেকী সুর গাঁথতে চেয়েছেন। ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ কাব্যের অধিকাংশ কবিতায় সমাজের এক অটুট বন্ধ্যাত্বের প্রতিকারহীনতা চেতনাশীল হয়ে উঠেছে; এর মর্মপ্রকোষ্ঠের ভিতে মাথা কুটে মরছে প্রৌঢ় উন্মাদগ্রস্ততা, অভিশপ্ত হয়ে উঠেছে প্রাণের সব আকুলতা। উল্লিখিত নিবন্ধে সে-আকুলতাই মর্মভেদী রূপ নিয়েছে।

ছবি : সংগৃহিত

‘বেলা অবেলা কালবেলা’-য় নারীর কী অবস্থান তারও সুলুক সন্ধান চালিয়েছেন সৈকত রহমান। অনুসন্ধানী সে-প্রতিবেদনের আন্তরিক উপস্থাপন হয়ে উঠেছে একটি পৃথক নিবন্ধ, যার নাম ‘তুমি যে শরীর নিয়ে রয়ে গেছ’। মনোগ্রাহী নিবন্ধটি ঠাঁই পেয়েছে বইয়ের সপ্তমে;

অষ্টমে রয়েছে ‘‘শিকার’ : শিল্পের মোড়কে প্রতিবাদ”। একটি কবিতা নিয়ে একটি নিবন্ধ। কবিতার নাম ‘শিকার’। বনলতা সেন কাব্যের একটি প্রতিবাদী কবিতা এটি। পাঠক-সংযোগের ক্ষেত্রে কবিতাটি যেমন দুর্বোধ্য নয়, তেমনই মনোগ্রাহী বা চমকে দেবার মতো কিছু উপমা-উৎপ্রেক্ষার উদাহরণও আছে, যা বাঙালি কবিতাপ্রিয় পাঠককে চিরকাল আনন্দই দেবে, প্রেম বিলাবে, এবং প্রেরণা যোগাবে প্রতিবাদী হতে; কেননা, প্রকৃতিচিত্রে মোড়ানো থাকলেও শিল্পের মোড়কে এটি প্রতিবাদেরই কবিতা– এমন উৎসাহব্যঞ্জক তথ্যপ্রমাণ উঠে এসেছে এ-নিবন্ধে।

‘হেমন্তে ঘাসে নীল ফুল ফোটে’ ‘রূপসী বাংলা’ নিয়ে সৈকত রহমানের আরেকটি নিবন্ধ। এরও যাবতীয় উপকরণ এসেছে ‘রূপসী বাংলা’-র নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও বিস্তৃত গবেষণা থেকে। বাঙলার সবকিছু নিয়ে তাকে আমৃত্যু ভালোবেসে কীভাবে সুখী হয়েছিলেন জীবনানন্দ তার আদ্যোপান্ত জানানো হয়েছে এ-নিবন্ধে : ‘রূপসী বাংলা’র প্রেমানুভূতি যেসব সৌন্দর্য ভাব ভাবাপন্নতা আমাদের ছোঁয়, ছেনে যায় এবং দ্রবীভূত করে, তার মধ্যে হেমন্ত ঋতুর পাতাদের কষ আঠা দারুণ করে মিশেল আছে। হেমন্তের শান্ত মাধুর্য কবিপ্রাণে কাব্যপ্রেরণার উৎস।… কলকাতার নাগরিকজীবনে বরিশালের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও তার ভেতরে নিজের সর্গসুখ আস্বাদনের সময়টুকুর কথা কবি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে স্মরণ করেছেন বরাবর। এ-নিবিড় নিবন্ধে সে দীর্ঘশ্বাসও টের পাওয়া যায়।

জীবনানন্দ দাশের কাব্যভূবনে সমুদ্র যে-স্বতন্ত্র ভূগোল ও চেতনার বিস্তৃত নিগূঢ়তা নির্মাণ করেছে সেদিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন সৈকত রহমান। অনাদিকাল থেকে সমুদ্রের সাথে মানুষের যে-সম্পর্ক ‘ঢেউয়ের গানের শব্দ’ শীর্ষক নিবন্ধে তার স্বরূপ উন্মোচনের প্রয়াস পেয়েছেন। এর সমর্থনে কবির কাব্য থেকেই আহরিত হয়েছে প্রয়োজনীয় সব উপাদান। এ-বিষয়ে আরও বিস্তৃত গবেষণা ও আলোচনা-অনুসন্ধানেরও সুযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

‘ধূসর পাণ্ডুলিপির অন্তর্গত জগৎ’– শব্দগুচ্ছ ইঙ্গিত দেয় জীবনানন্দের ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ কাব্যের অন্তর্গত জগতের কথাই বলা হয়েছে এ-নিবন্ধে। তাহলে কী আছে সে-জগতে? কবি একই সাথে মৃত্যু ও পরাজয়, শুভ ও সুন্দরের নান্দিকার– এ-বৈপরীত্যময় বোধগুলোকে মানবমনে একই অবস্থায় ঠাঁই দেয়ার যৌক্তিক শিল্পানুশীলনেই হয়ে উঠেছে ধূসর পাণ্ডুলিপি। মানুষের সব সৃষ্টি, সভ্যতা ও জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ ও প্রেমবোধ নিয়ে এ-কাব্যের যে-ধূসর রং ও রূপ, এবং তার আড়ালে লুকানো শক্তিমান ও মহত্তর অনুভবের কবি, তারও স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে।

ষড়ঋতুর অন্যতম হেমন্ত-কে কীভাবে দেখেছেন নিবন্ধকার, এবং জীবনানন্দেই বা তাকে কীভাবে পেয়েছেন, তার হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা দিয়েছেন ‘তবুও হেমন্ত’-এ। পরিশেষ এ-নিবন্ধে তিনি হেমন্তের প্রতি নিজের ব্যক্তিগত দুর্বলতা ও অনুভূতির সাথে জীবনানন্দের কবিতায় ব্যক্ত উপলব্ধির কী আশ্চর্য মিল তা জানিয়েছেন। তাঁর ভাষায়: ‘হেমন্ত হলো সেই বিষাদ মায়ার ঋতু, যা আমাকে দেয় অন্তর্গত ভাবনা সংগ্রহের অনুপ্রেরণা; নমিত করে, প্রণত করে, করেছিল আমাকে শৈশবে বারবার…’।

কাব্যিক হলেও সমগ্র উপস্থাপনে মেধা ও মননের সমন্বয় ঘটেছে ‘জীবনানন্দ দাশের কাব্য : ১২ নিবন্ধ’-এ; প্রয়োজনীয় তত্ত্ব ও তথ্যেরও কমতি পড়েনি। তবু কথা থেকে যায়, বুদ্ধদেব বসু যেমনটি বলেছিলেন: ‘জীবনানন্দ হচ্ছে নদীর স্রোতের মতো, কোথাও আঙুল দিয়ে বলা যাবে না যে এই হলেন জীবনানন্দ। জীবনানন্দ অতুলনীয় কারণ কোনও একটা একক রচনা দিয়ে তাঁকে চিহ্ণিত করা যাবে না, যেমন ফাউস্ট দিয়ে করা যাবে না গ্যাটে-কে, রবীন্দ্রনাথকে চিহ্ণিত করতে হবে তাঁর ব্যাপ্তি, বৈচিত্র্য ও পরিবেশন দিয়ে।’ এ-বাস্তবতায়ও সৈকত রহমানের ‘জীবনানন্দ দাশের কাব্য : ১২ নিবন্ধ’-এ জীবনানন্দের কবিতার ভিন্ন ও স্বতন্ত্র পাঠ নেওয়া যায়। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় উপস্থাপিত এ-পাঠ শুধু মুগ্ধ, বিস্মিত ও প্রাণিত করে না, বোধের লবণে দ্রবীভূত করে।

শিল্পী সুখেন দাসের আঁকা মনোরম প্রচ্ছদের এ-মলাটবন্দী আয়োজন বাঙলার ইতিহাস-ঐতিহ্য ও নিসর্গের সাথে জীবন ও প্রকৃতিকে, আদিগন্ত নতুন আলোয়, পরম মমতায়, ছুঁয়ে-ছেনে দেখার ডাক দেয়। গ্রন্থের ললাটে কাটা সংখ্যার তিলকটিও গ্রন্থিত নিবন্ধগুলোর বাইরে, জীবনানন্দ দাশের কাব্যের ওপর, গ্রন্থকারের আরও নিবন্ধের ইঙ্গিত দেয়; এবং সে-অগ্রন্থিত নিবন্ধেরও একটি গ্রন্থিত রূপ দেখতে আগ্রহ যোগায়। সবমিলিয়ে এ-এক অনন্য-সাধারণ পাঠ। সবুজ ঘাসের মতো নিবিড় ও সমৃদ্ধ এ-পাঠ পাঠককে জীবনানন্দ চর্চায় আরও উৎসাহিত করবে।