নায়াগ্রা জলপ্রপাত। এ যেন এক স্বপ্নপুরী! চারিদিকে সুন্দরের হাতছানি। কি এক মায়াবী দৃশ্য।যেখানে গেলে আর ফিরতে ইচ্ছে হয় না। মানুষ প্রকৃতির পূজারী। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নৈসগিক রুপ দেখার জন্য মানুষ ছুটে চলেছে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। নায়াগ্রা জলপ্রপাত পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম জলপ্রপাত। নায়াগ্রা জলপ্রপাতের হৃদয়ছোঁয়া নৈসর্গিক সৌন্দর্য অবলোকন করতে প্রতি বছর এখানে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ২ কোটী ৮০ লাখেরও বেশী পর্যটক সমবেত হন। নায়াগ্রার নয়নাভিরাম দৃশ্য মানুষকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে জলপ্রপাতের বৈচিত্রময় রুপ দেখার পর সেখান থেকে আসতে মন চায় না । সূর্যোদয়ের সময় তার একরুপ, রাতে অন্যরুপ, দুপুরে প্রখর সূর্যের আলোয় আরেক রুপ,গোধূলি লগ্নে আরেক রুপ, রাতে যখন চারিদিকে আলো জ্বলে উঠে তখন আরেক স্বপ্নপুরী। খুব কাছ থেকে দেখা যায় নায়াগ্রার জল কিভাবে নীচে পড়ছে। জল নীচে পড়ার আগেই জলীয় বাষ্পের মতো রুপ ধারণ করে নীচের অংশ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে ফেলে। সেই ধোঁয়ায় যখন সূর্যের আলো পড়ে তখন সেখানে সৃষ্টি হয় রংধনু। সেই অপরুপ সৌন্দর্য অবলোকনের জন্য দর্শকরা বাতাসে ভেসে আসা জল কণায় ভিজে তা খুব উপভোগ করেন।
নায়াগ্রার জলকণা যেন পুষ্পবৃষ্টি দিয়ে বরণ করে পর্যবেক্ষকদের।জলপ্রপাতের চারিদিকে দলবাধা সি গালদের উড়াউড়ি, ধূধূ বাতাস আর জল পড়ার সা সা শব্দ সেখানে মায়াবী এক পরিবেশের সৃষ্টি করে। যে কারোরই কবিতা আবৃত্তি করতে ইচ্ছে করবে। ইচ্ছে করবে প্রাণ খুলে গাইতে, “আজ কোথাও আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা”।গোধূলী লগ্নে আকাশে আবীরের রং সি গালদের দলবেধে ঘরে ফেরার দৃশ্য কবি নয় যে কারোরই দৃষ্টি এড়ায় না। নায়াগ্রা জলপ্রপাত কানাডার অন্টারিও প্রদেশের দক্ষিণ পূর্বে এবং আমেরিকার নিউইয়ক অঙ্গরাজ্যের উত্তর পশ্চিমে অবস্হিত। এরি লেইকের জলরাশি থেকে সৃষ্ট নায়াগ্রা নদী উৎপত্তিস্হলে দুইভাগে বিভক্ত হয়ে বড় অংশটি নায়াগ্রা জলপ্রপাতে এবং ক্ষুদ্র অংশটি আমেরিকান জল প্রপাতের সৃষ্টি করেছে। এই দুই জলপ্রপাত দুই সহোদরার মত পাশাপাশি অবস্হান করছে। নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখতে অশ্বক্ষুরাকৃতি বলে একে হস সু ফলস বলা হয়। কানাডীয় অংশে ১৭৩ ফুট উপর থেকে এবং আমেরিকান অংশে প্রায় ১০০ফুট উপর থেকে নীচে জল পড়ে। নায়াগ্রা জলপ্রপাতের প্রস্হ ২৬০০ফুট,আমেরিকান প্রস্হ ১১০০ ফুট।আমেরিকা ও কানাডা উভয় দিক থেকেই প্রপাত দুটো দেখা যায়।প্রপাতে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১৫ লাখ গ্যালন জল নীচে পড়ে। নায়াগ্রা নদীর জল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।এটি পৃথিবীর বৃহত্তম জল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র।কানাডীয় সাইডে ২ মিলিয়ন কিলোওয়াট এবং আমেরিকা সাইডে ২.৪মিলিয়ন কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়ে থাকে।উপর থেকে যেমন জলপ্রপাত দুটো দেখা যায় তেমনি বোটে করে খুব কাছ থেকে নায়াগ্রা নদী থেকে প্রপাত দুটো দেখার ব্যবস্হাও রয়েছে।প্রপাতের কাছেই রয়েছে স্কাইলন টাওয়ার,সেটি প্রপাত থেকে ৮০০ ফুট উচুঁ, সেখান থেকেও খুব সুন্দর ভাবে প্রপাতের দৃশ্য দেখা যায়।এছাড়াও নদীর উপর ঝুলন্ত হোয়ার্লপুল এয়ারো কারে চড়ে দেখা যায় জলপ্রপাতের মনোরম দৃশ্য ও কাছের পাহাড়ের বৈচিত্রময় দৃশ্য। মে মাসের ১৬ তারিখ থেকে আগষ্টের ৩১ তারিখ পর্যন্ত প্রতি শুক্র ও রবিবার,সেপ্টেম্বর মাসের প্রতি শুক্রবার এবং আমেরিকা ও কানাডার প্রধান প্রধান ছুটির দিনে রাত ১০টায় প্রপাত এলাকায় আতশবাজি পোড়ানো হয়। আতশবাজির শব্দ ও আলোয় আকাশ হয় রঙ্গীন তখন এক মায়াবী দৃশ্যের অবতারণা হয়। নায়াগ্রা জলপ্রপাতকে ঘিরে এখানে গড়ে উঠেছে বিশাল বিশাল উচ্চ দালান, হোটেল মোটেল,রেষ্টুরেন্ট,বিনোদনের জন্য রয়েছে কুইন্স ভিক্টোরিয়া পার্ক, ক্যাসিনো, গলফ ক্লাব, নায়গ্রা হিষ্ট্রিকাল সোসাইটি, মিউজিয়াম, আট গ্যালারী,নায়াগ্রা এক্যুরিয়াম,জিওলজিকাল মিউজিয়াম, কেনাকাটার জন্য রয়েছে বিরাট বিরাট শপিং কমপ্লেক্স, প্লাজা,সুপার মার্কেট,স্টোর, কারেন্সী এক্সচেন্ঞ্চ সেন্টার,তথ্য কেন্দ্র,অনতিদূরে রয়েছে লেক এরি ও লেক অন্টারিও।নায়াগ্রা জলপ্রপাতের অপরুপ দৃশ্য দেখার জন্য পর্যটকরা বছরের সবসময়ই এখানে ভীড় জমান তবে সবচেয়ে বেশী লোক সমাগম হয় জুন,জুলাই ও আগষ্ট মাসে।
এটি এখন বিশ্বখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। নায়াগ্রা জলপ্রপাতের নাম শুনলে পযটকদের চোখের সামনে ভেসে উঠে স্বগীয় একরুপ। এখন যেখানে জলপ্রপাতটি দাঁড়িয়ে আছে ১২ হাজার বছর আগে তা ছিল সাত মাইল ভাটিতে। নদী ভাঙ্গনে তা পিছনের দিকে সরে যাচ্ছে। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত বছরে গড়ে ৩ ফুট নদী ভাঙ্গন ছিল। বতমানে ১০ বছরে ১ ফুট ভাঙ্গছে। নায়াগ্রা নদী প্রায় ৩৫ মাইল দীর্ঘ। এর উজানে রয়েছে এরি হ্রদ এবং ভাটিতে রয়েছে অন্টারিও হ্রদ। অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনা,অসম্ভকে সম্ভব করা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ সেই চেষ্টাই করে আসছে। নায়াগ্রা জলপ্রপাত পাড়ি দিতে গিয়ে কত লোক নায়াগ্রার জলেই হারিয়ে গেছে তার হিসেব হয়ত কেউই জানে না। ১৮৫৯ সালে প্রথম জিন ফ্রানকুইজ গ্রেভলেট(যিনি ব্লনডিন নামে অধিক পরিচিত)রশির উপর দিয়ে নায়গ্রা জলপ্রপাত পাড়ি দেন। ১৯০৭ সালে এন টেলর নামে এক মহিলা ব্যারেলের সাহায্যে নায়াগ্রার প্রবল জলরাশিকে অতিক্রম করে এপার থেকে ওপার যান।
নায়াগ্রা জলপ্রপাতের ইতিহাস: আজ থেকে প্রায় ১২ হাজার বছর আগে এখানে মানুষের পদচারণা পড়ে। এখানের ভূমি তুন্দ্রা ও স্পুস ফরেষ্টের সমন্বয়ে গঠিত। আজ থেকে ৯ হাজার বছর আগে এখানের বাসিন্দা ছিল ক্লোভিস জনগন। এরি লেইকের তীরবতী অন্ঞ্চলে নমভিক শিকারীরা ছোট্ট ছোট্ট গুহায় বাস করতো,শিকার, মাছ ধরতো।গ্রীষ্মে পাহাড়গুলোতে যেমন পশু পাখী জড়ো হতো তেমনি মেরু অন্ঞ্চলের ছোট বড় শিকারী দল সমবেত হতো শিকারের জন্য।হরিণ,মাছ এবং এখানের বৃক্ষরাজি তাদেরে আকৃষ্ট করতো। সে সময়টাকে প্রাচীন যুগ বলা হয়(৯০০০—৩০০০ বছর আগ পযন্ত)।এর পরের সময়টাকে (৩০০০—৩০০ বছর আগ পযন্ত)বলা হয় উডল্যান্ড কাল। এসময়ে অধিবাসীরা গম,ভূট্টা,সীম,বরবটি চাষ করতো,সে সময়ে লাশ কবর দেয়া,পোড়ানো বা জলে ভাসিয়ে দেয়ার প্রচলন ঘটে। এবং সে সময় থেকে রাজনৈতিক সমাজ ব্যবস্হা গড়ে উঠে।তখন গ্রামগুলো পরিচালিত হতো নিবাচিত প্রতিনিধি দ্বারা,গ্রামগুলোর পার্বত্য উপজাতিয়দের মধ্যে একটি শক্তিশালী সামাজিক বন্ধন ছিল। ১৫০০ সালের দিকে ইউরোপিয়রা এখানে আসতে শুরু করে। অন্টারিওর হুরন,পেটুন ও নিউট্রাল এই ত্রিজাতির ঐক্যকে এরা অবহেলা ও অবদলিত করতে থাকে। যারা প্রকৃতি প্রেমিক তারা নায়াগ্রা অন্ঞ্চলে থেকে যায়। এখনো সেই মোহান্ধ সময়কালের জীবিকাবাহিরা সে সব ব্যাখ্যা করে কেঁদে উঠে। ১৫৩৫ সালে এবং এর পরবতী সময়ে সাম্রাজ্য বিস্তারের লক্ষ্যে ফ্রান্স থেকে অনেকেই কানাডা আসেন কিন্তু কেউই নায়াগ্রা জলপ্রপাত এলাকায় যান নাই। এটিনি ব্রুলি প্রথম ইউরোপিয়ান যিনি লেইক অন্টারিও, এরি,হুরন ও সুপরিয়র হ্রদগুলো পযবেক্ষণ করেন এবং সম্ভবত তিনিই প্রথম ১৬১৫ সালে এই জলপ্রপাতে গমন করেন। ১৬৫১ সালে শেতাঙ্গরা এখানের আদিবাসিদের বিদায় করে স্হায়ী আবাস গড়ে। ১৬৭৮ সালে পাদ্রীদের প্রধান লুইস হেনিপিন নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখতে যান এবং এর ১৯ বছর পরে তাঁর রচিত বই “নোভেলি ডেকোভারটে” এই জলপ্রপাত সম্পকে বর্ণনা করেন। এই বই লেখার পর ১৭০০ সালের দিকে মানুষ এ সম্পর্কে জানে এবং দেখতে যায়।
তখন নদী পথই ছিল যোগাযোগের একমাত্র অবলম্বন। ১৮২০ সাল নাগাদ এখানে পর্যটকদের যাওয়া শুরু হয়। ১৮৯৬ সাল নাগাদ এখানে গড়ে উঠে সড়ক ও ট্রেন যোগাযোগ। বর্তমানে সড়কপথ, জলপথ, আকাশপথ, রেলপথে যাওয়ার রয়েছে সুবন্দোবস্ত।নায়াগ্রা জলপ্রপাত পর্যটকদের কাছে এখন প্রধান আকষনীয় স্হান।বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক চার্লস ডিকেন্স ১৮৪১ সালে নায়াগ্রা জল প্রপাত পরিদর্শন করে বলেছিলেন,”নায়াগ্রা ওয়াজ এট ওয়ানস স্টাম্পড আপন মাই হার্ট এন ইমেইজ অফ বিউটি টু রিমেইন দেয়ার চেইন্ঞ্জলেস এন্ড ইনডিলেবল ইফনিট ইটস পালস সীস টু বীট ফরএভার।‘’পৃথিবীতে কিছু কিছু জিনিষ আছে যে গুলো চোখে দেখা যায়,অনুভব করা যায়,অনুধাবন করা যায়,উপলব্ধি করা যায় কিন্তু কাউকে এর সৌন্দর্য বর্ণনা করে বুঝানো যায় না ঠিক তেমনটি প্রকৃতি প্রদত্ত নায়াগ্রা জলপ্রপাতের ব্যাপারে বলা যায়। নায়াগ্রার হ্রদয় কাড়া সৌন্দর্য প্রকৃতি প্রেমীদের নিত্য আহবান জানায় এবং সে আহবানে সাড়া দিয়ে প্রতি বছর লাখ লাখ পর্যটক এখানে আসেন। আগামীতে যারা জলপ্রপাতে যাবার কথা ভাবছেন তাদের জন্য কয়েকটি ট্রিপস : সেখানে যাওয়ার জন্য, জুলাই ও আগষ্ট মাস হবে উত্তম। কারণ সে সময় এ এলাকায় আবহাওয়া থাকে ভাল তবে সামার জ্যাকেট বা রেইন কোট নিতে ভূলবেন না যেন।(লাইফ জ্যাকেট থাকলে ভাল)ভালভাবে সবকিছু দেখতে হলে দু’দিন-দু’রাত থাকার প্রোগ্রাম থাকতে হবে। এখানে কম খরচে থাকা খাওয়ার সুবন্দোবস্ত আছে। ডাবল বেড ৮০ ডলার থেকে ২৫০ ডলার পর্যন্ত। ২০০ ডলারেও দু’জনের থাকা সম্ভব। এখানে রয়েছে রেন্ট এ কার, বাস সার্ভিস, ট্যাক্সি, সাটল বাস সাভিস। নিদিষ্ট পরিমাণ ভাড়া দিয়ে বাসে দর্শনীয় স্হান পরিদর্শনের সুবিধা। ঘোড়ার গাড়ীতে করে বেড়াতে পারবেন জলপ্রপাত এলাকা। নায়াগ্রা জলপ্রপাতের সাথে নিজেকে একি ফ্রেমে বন্দী করতে একটা ক্যামেরা নিতে ভূলবেন না যেন।