ছোটবেলা থেকেই দেখতাম শীতের সময়টা এলে শ্রীমঙ্গলে প্রবাসী পাত্র ও ঘটকদের আনাগুনা বেড়ে যেতো সুন্দরী পাত্রীর খোঁজে । সে সময় থেকেই বিভিন্ন জনের মুখে শুনতাম “শ্রীমঙ্গলের মেয়েরা নাকি সুন্দরী” । বিষয়টা নিয়ে আগে তেমন করে ভাবিনি । সম্প্রতি কয়েকজন প্রবাসী তাদের আত্মীয় স্বজনের বিয়ে করাতে দেশে যাচ্ছেন, আমাকে তারা প্রায় সব কজনই শ্রীমঙ্গলে আমার জানাশুনা কোনো মেয়ে আছে কি না জানতে চান । আমি জানতে চাইলাম শ্রীমঙ্গল কেন ? জবাবে তারা প্রায় সবাই একই উত্তর দিলেন “শ্রীমঙ্গলের মেয়েরা নাকি সুন্দরী” স্মার্ট ও অতিথিপরায়ণ। বিষয়টা নিয়ে ভাবলাম । হাতের কাছে যে বই পুস্তক আছে সেগুলি নিয়ে একটু ঘাটাঘাটি করে এর কিছুটা প্রমাণ পেলাম । বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা সম্পাদিত (সংগ্রাহক ও সংকলক : আম্বিয়া খাতুন) “ছিলটে প্রচলিত পই-প্রবাদ ডাক-ডিঠান” গ্রন্হে একটি প্রবাদ হচ্ছে “সাতগাঁও বালিশিরা, মাইঝে মাইঝে ছড়া, বেটি গুইন সুন্দর-সান্দর, বেটা গুইন মরা” । “প্রয়োগ ও প্রসঙ্গ আলোচনা : অর্থাৎ সাতগাঁও ও বালিশিরা বা বালিহীরা অঞ্চলে মাঝে মাঝে অনেকগুলি পাহাড়ী ছড়া বা নালা-নদী বয়ে গেছে এবং এ অঞ্চলের মেয়েগুলি সুন্দরী-সুগঠনা কিন্তু বেটা ছেলেগুলি হেংলা পাতলা গড়নের হয়ে থাকে । এই ছড়াটিতে সাতগাঁও ও বালিশিরা অঞ্চলের প্রাকৃতিক অবস্থাসহ সেখানকার নর-নারীর স্বাস্থ্য ও শ্রী সৌন্দর্যের বাস্তব বর্ণনা তুলে ধরার চেষ্টা লক্ষিত হয় ।
এ অঞ্চলের নর-নারীদের দৈহিক গড়ন ও রূপলাবণ্যের সাথে খাসিয়া অঞ্চলের খাসিয়া জাতিদের স্ত্রী পুরুষের দেহ কাঠামো ও রূপশ্রীর একটা তুলনা করা যেতে পারে । কারণটি সম্ভবত আবহাওয়াগত প্রাকৃতিক প্রভাবও হতে পারে। অথবা কোন এক বিস্মৃত অতীতে এ অঞ্চলের লোকদের সাথে ওইসব উপজাতীয় রক্তের শঙ্কর মিশ্রণ ঘটে থাকবে। যার ফলে হয়ত সে রক্তের ধারাটি ইতিহাসের অগোচরে আজো বয়ে চলেছে”। ভৌগালিক অবস্থানের কারণে অনেক সময় মানুষের দেহের গড়ন, উচ্চতা, রং, মেজাজ ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে । ৪৫০ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভূ প্রকৃতি, আবহাওয়া দেশের অন্যান্য স্থানের চেয়ে একটু ভিন্ন। এখানে বালিশিরা ও সাতগাঁও অঞ্চলের মাটি বালিযুক্ত, ভূনবীর, মির্জাপুর এলাকার মাটি পলিযুক্ত। শ্রীমঙ্গলে রয়েছে সুউচ্চ পাহাড় অন্যদিকে রয়েছে বিশাল জলরাশির হাইল হাওড়, নদী, নালা, খালবিল, লেক। রয়েছে সবুজের চাদরে মুড়ানো চা বাগান, প্রকৃতির এক লীলাভূমি লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্দান, রাবার বাগান, আনারস বাগান। দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয় এখানে, শীতের সময় প্রচন্ড শীত।এখানে খাসিয়া, মনিপুরি, সাওতালসহ অনেক আদিবাসীদের বাস। স্মৃতিশক্তি যদি প্রতারণা না করে থাকে সম্ভবত আশির দশকে দিলীপ বিশ্বাস “বন্ধু” নামে একটি ছবি পরিচালনা করেছিলেন, সে ছবিতে গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা এবং সত্য সাহার সুরে একটি গান ছিল । সে গানেও সিলেট অঞ্চলের মেয়েরা যে সুন্দরী তার উল্লেখ ছিল। এছাড়াও আঞ্চলিক বিভিন্ন গানে, ধামাইলে পই বা ডিঠানে এর সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায় । বালাগঞ্জের লেখক ও সমাজ সংস্কারক শ্রী রজনীকান্ত মহাশয় তার এক পত্রে ছোট ভাইকে লিখেছিলেন, “অরবিন্দ শ্রীমঙ্গলের শিবরাত্রির মেলায় যখন যাচ্ছো, দেখবে মেলায় অনেক মেয়েছেলে আসবে, আমাদের শৈলেনের জন্য একটা সুন্দরী পাত্রী যদি পাওয়া যায় তবে আসছে ফাল্গুনে বিয়ের লগ্নটা ধরতে চাই ।